বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। এ ছয়টি ঋতুকে আমরা প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করতে পারি। একটি শীতকাল, অন্যটি গ্রীষ্মকাল। শীতকালে মানুষের রোগ-ব্যধি তুলনামূলকভাবে কম হয়। কিন্তু গ্রীষ্মকালে আবহাওয়ার কারণেই অনেক বেশি পরিমাণে অসুখ-বিসুখ দেখা দেয়। গরম কালের রোগব্যাধির মধ্যে ডায়রিয়া অন্যতম। অতীতে এক সময় ডায়রিয়া মহামারী আকারে দেখা দিত। গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়তো। অনেক মানুষ এ রোগে মারা যেতেন। এখন আর সেদিন নেই। খাবার স্যালাইন ব্যবহারের ফলে ডায়রিয়া এখন আর মহামারী আকার নিতে পারে না। ডায়রিয়া পীড়িত এলাকায় আইসিডিডিআরবি’র আবিষ্কৃত খাবার স্যালাইন বহু মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। যার মধ্যে শিশুরা উল্লেখযোগ্য।
বন্যা ও বর্ষণজনিত রোগ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বর্তমান মৌসুমে আমাদের দেশে সাধারণত তিন মাস থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুরা ডায়রিয়া, কলেরা, জ্বর, নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, আমাশয় ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হয়। কারণ একদিকে আবহাওয়ার পরিবর্তন, অন্যদিকে অপ্রত্যাশিত বন্যা ও বর্ষণ। নিম্ন আয়ের পরিবারের লোকদের মধ্যে এসব রোগ বেশি হয়ে থাকে। আর্থিক সংকটের কারণে গরিব মা-বাবা শিশুদের প্রতি ততটা যত্ন নিতে পারেন না। পুষ্টিকর খাবারের জোগানও তারা দিতে পারেন না। সঠিক সময় চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে অকালেই মারা যায় অনেক শিশু।
সম্প্রতি গরমের কারণে রাজধানী ও এর আশপাশে ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়েছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় ব্যাধি গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি), ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ডায়রিয়া ও কলেরা রোগীর ভর্তি হার বেড়েছে। ডাক্তারদের মতে, সারা বছর ডায়রিয়ার রোগী ভর্তি হচ্ছে। তবে গত কিছুদিন গরম আবহাওয়ার কারণে রোগীর সংখ্যা অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। রোগীদের ৪০ শতাংশ শিশু, ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কলেরার রোগী রয়েছে। ঢাকার বাইরের অনেক জেলায়ও ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে।
পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, হাত না ধুয়ে কোনো কিছু খেলে বা বাসি, পচা খাবার খেলেও ডায়রিয়া হতে পারে। অনেকেই ওয়াসার সরবরাহকৃত লাইনের পানি পান করেন। পানির মাধ্যমে ডায়রিয়ার জীবাণু বেশি ছড়ায়। তাই পানি ফুটিয়ে পান করা সবচেয়ে নিরাপদ। আবার কেউ কেউ রাস্তাঘাটে খোলা খাবার এবং শরবত খেয়েও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন। বারবার পাতলা পায়খানা হলে, বমি হলে, ঝুঁকি না নিয়ে নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে রোগীকে ভর্তি হতে হবে।
ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী বার বার পাতলা পায়খানা করার ফলে শরীর থেকে অনেক পানি ও লবণ বেরিয়ে যায়। ফলে রোগীর শরীর পানিশূন্য হয়ে পড়ে। সে কারণে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের দ্রুত খাবার স্যালাইন খাওয়াতে হবে। ডায়রিয়া শুরু হলে আধা সের/লিটার বিশুদ্ধ পানিতে এক প্যাকেট খাবার স্যালাইন ভালোভাবে গুলিয়ে রোগীকে খাওয়াতে হবে। যতবার পাতলা পায়খানা হবে, ততবারই খাবার স্যালাইন খাওয়াতে হবে। যে কোনো ঔষধ এবং পানের দোকানেও আজকাল খাবার স্যালাইনের প্যাকেট কিনতে পাওয়া যায়। বানানো খাবার স্যালাইন ৬ (ছয়) ঘণ্টা পর্যন্ত খাওয়ানো যায়। এরপর প্রয়োজন হলে আবার নতুন করে খাবার স্যালাইন বানাতে হবে। শিশুর ডায়রিয়া হলে খাবার স্যালাইনের পাশাপাশি মায়ের বুকের দুধ বেশি করে খাওয়াতে হবে। এছাড়া বড়দের স্বাভাবিক সবধরনের খাবার খাওয়াতে হবে। তবে তরল জাতীয় খাবার বেশি করে খাওয়ানো দরকার। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের ভাতের মাড়, ডাবের পানি, চিড়ার পানি, লবণ-গুড়ের শরবত, খাবার স্যালাইন, বিশুদ্ধ খাবার পানি খাওয়াতে হবে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগীদের জন্য আলাদা ইউনিট খোলা হয়েছে। সেখানে রোগীদের বিশেষভাবে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
ডায়রিয়া একটি সাধারণ রোগ। আজকাল ডায়রিয়া বা কলেরায় মৃত্যু হার অনেক কম। আক্রান্ত হলে মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে, কার্যক্ষমতা কমে যায়। তাই সরকারের পাশাপাশি গণমাধ্যমেরও উচিত ডায়রিয়া প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা। ডায়রিয়া থেকে বাঁচতে বিশুদ্ধ খাবার পানি এবং টাটকা খাবার খেতে হবে। পচা ও বাসি খাবার খাওয়া যাবে না। বাজারের খোলা খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। বয়স্ক ও শিশুদের প্রতি বাড়তি মনোযোগ দেওয়া দরকার। এ সময় শিশু ও বয়স্কদের আঁটসাঁট নয় ঢিলেঢালা পোশাক পরতে হবে। পোশাক সুতির হলে বেশি ভালো হয়। মনে রাখতে হবে ’প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর’। – বাসস।
0 Comments