একজন কৃষক সারাদিন মাঠে কাজ করে বিকালে বাড়ি পৌঁছে খাওয়া-গোসল শেরে যাচ্ছেন চিকিত্সকের কাছে। চিকিত্সক ফ্রি তাকে দেখে পরামর্শ লিখে দিচ্ছেন, দিচ্ছেন প্রয়োজনীয় ওষুধও। এমন চিত্র বাংলাদেশে কল্পনা করা কঠিন। সেই কঠিন কাজটি শুরু হয়েছে নওগাঁ জেলায়। রাজধানীতে শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বৈকালিক স্বাস্থ্য সেবা পাওয়া যায়। আর কোথাও ছিল না এই সেবা। সেটা শুরু হয়েছে নওগাঁও। সেখানকার স্বাস্থ্য বিভাগ অনুধাবন করেছে, একজন কৃষকের পক্ষে সকালে মাঠে না গিয়ে হাসপাতালে গেলে তার পুরো দিনটাই নষ্ট হয়ে যায়। ফলে খেটে খাওয়া মানুষের জন্য তাদের এই চমত্কার উদ্যোগ।
নওগাঁর এই উদ্যোগ সফল হওয়ার পর স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে সারাদেশের সব সরকারি হাসপাতালে বৈকালিক সেবা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ি, ঢাকার ধামরাই, সিরাজগঞ্জের কাজীপুর, নরসিংদীর শিবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং টঙ্গী ও মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতাল বহিঃবিভাগে বৈকালিক চিকিত্সা সেবা চালু হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ইত্তেফাককে বলেন, নওগাঁয় আমরা বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা চালু করে সফল হয়েছি। এখন সারাদেশে এটা করতে চাই। বিকালে আর দরিদ্র রোগীদের টাকা দিয়ে ডাক্তার দেখাতে হবে না।
নওগাঁ প্রতিনিধি তন্ময় ভৌমিক জানান, নওগাঁর সিভিল সার্জন অফিস থেকে গত বছরের ২৬ মার্চ প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে মান্দা উপজেলা হাসপাতালের আউটডোরে এই বৈকালিক সেবা কার্যক্রম চালু করেছিল। কিছুদিন যেতে না যেতে দেখা দিয়েছে এই সেবার সাফল্য। মান্দায় এ পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার রোগী এ বৈকালিক চিকিত্সা সেবা নিয়েছেন। এদের মধ্যে অধিকাংশ মহিলা ও শিশু। সে সময় হাসপাতালের ১১ জন চিকিত্সক নিজেদের প্রাইভেট প্রাকটিস বাদ দিয়ে বিনা বেতনে রোগীদের চিকিত্সা অব্যাহত রেখে দেশের স্বাস্থ্য সেবায় এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
মান্দার পর গত বছরের ১৬ আগস্ট বদলগাছী উপজেলা স্বাস্থ্য হাসপাতালে একই কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। সেখানেও মেলে সাফল্য। এরপর থেকে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার রোগী এ বৈকালিক চিকিত্সা সেবা নিয়েছেন। সর্বশেষ পত্নীতলা উপজেলায় গত অক্টোবর মাসে এ সেবার উদ্বোধন করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এমপি। গত এক মাসে বদলগাছী উপজেলা হাসপাতালে ৫০০ রোগী চিকিত্সা সেবা নিয়েছেন। এর মধ্যে মহিলা ও শিশুই ৬৫ ভাগ।
নওগাঁর সিভিল সার্জন ডা. মোজাহার হোসেন ইত্তেফাককে বলেন, কৃষি প্রধান এ অঞ্চলের মানুষের দিনের শুরুতেই মাঠে কাজ করতে যেতে হয়। কৃষিকাজের কারণে এখানকার অধিকাংশ লোকজন সকালে সরকারি চিকিত্সা সেবা নিতে পারে না। এর ফলে বিকালে বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে অর্থ দিয়ে চিকিত্সা সেবা নিতে হয় সাধারণ মানুষদের। এ সব মানুষদের কথা চিন্তা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈকালিক স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রমের পর নওগাঁর মান্দায় দেশের প্রথম এই সেবা শুরু হয়। মাত্র তিন টাকার টিকিট কেটে খুব সহজেই বিকাল ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত সাধারণ মানুষ বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকদের দেখাতে পারেন। নওগাঁর অন্য উপজেলাগুলোতেও এই বৈকালিক সেবা চালু করার ইচ্ছার কথাও জানান তিনি।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য বিভাগ এই বৈকালিক চিকিত্সা সেবা একটি প্রকল্পের আওতায় নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। যে সব চিকিত্সক রোগীদের এই বৈকালিক চিকিত্সা দিয়ে থাকেন তাদের কোনো পারিশ্রমিক দেওয়া হয় না। তরুণ চিকিত্সকদের এই সেবায় আগ্রহী করতে আগামীতে তাদের উত্সাহ ভাতা বা পারিশ্রমিক দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ ইত্তেফাককে বলেন, এই মহত্ উদ্যোগটি যাতে আরো বৃহত্ করা যায় তার সব ধরনের চেষ্টা আমরা করছি। সামনের দিনগুলোতে সব সরকারি হাসপাতালে এই সেবা চালু করা হবে।
0 Comments